অবৈধ গাড়ি ঢাকার ‘বিষফোঁড়া’
যুগান্তরের অনুসন্ধান ও বিভিন্ন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের তথ্যমতে, ঢাকা শহরে সড়ক-খাস জমি দখল করে গড়ে ওঠা বড়-মাঝারি আকারের বাস-ট্রাকস্ট্যান্ডের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০টি। এর বাইরে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছোট আকারের বাস ও ট্রাকস্ট্যান্ড। আর গ্যারেজ এবং মোটরপার্টসের অবৈধ দোকান রয়েছে লক্ষাধিক। যার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দফতরগুলোর কাছে। অথচ এসব অবৈধ স্থাপনা ঢাকা শহরের যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি দূষণ করছে বাসযোগ্য পরিবেশের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র, ব্যস্ততম কারওয়ান বাজার সংলগ্ন রেলওয়ে এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৪০ বিঘা জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল। এর ভেতরে রয়েছে ১৫-২০ বছরের পুরনো অকেজো গাড়ির বিশাল সমাহার। এছাড়া সেখানে আছে অসংখ্য অবৈধ মোটরপার্টসের দোকান ও গ্যারেজ। অভিযোগ রয়েছে, এই টার্মিনাল থেকে ট্রাক মালিক-শ্রমিক এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা মাসে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেন। একই সঙ্গে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের নিরাপদ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে টার্মিনালটি। সম্প্রতি এই অবৈধ টার্মিনাল উচ্ছেদের ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে শ্রমিকদের বাধায় কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ডিএনসিসির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, রাজধানীর বাইরে স্থানান্তরিত করা হবে এই অবৈধ ট্রাক টার্মিনাল।
এছাড়া পুরান ঢাকার ধোলাইখালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬ বিঘা জমি এবং দয়াগঞ্জে সাড়ে ৫ বিঘা জমি দখল করে ট্রাক মালিক ও শ্রমিক নেতারা গড়ে তুলেছেন দুটি অবৈধ ট্রাক টার্মিনাল। কয়েক যুগ ধরে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের চোখের সামনে এসব অনিয়ম সংগঠিত হলেও এ ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন জনপ্রতিনিধিরা। ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন। ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ ইতিমধ্যে অবৈধ দখলদারদের সময় বেঁধে দিয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবৈধ দখলদাররা সরে না গেলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের লালবাগ অংশের সড়ক-খাস জমি ও বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর পাড় দখল করে ডিএসসিসির এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের সাবেক এক কাউন্সিলরের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে অবৈধ দুটি ট্রাক টার্মিনাল। এই দুটি ট্রাক টার্মিনালের ব্যাপারে কিছুই জানে না ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের শহীদনগর অংশের ট্রাক টার্মিনালটি গড়ে তুলেছেন ডিএসসিসির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন বি.কমের নেতৃত্বে। প্রতিদিন এই ট্রাক টার্মিনালে এক থেকে দেড়শ’ গাড়ি রাখা হয়। দৈনিক গাড়িপ্রতি ১০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এ ব্যাপারে কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন বি.কমের বক্তব্য জানতে চাইলে ডিএসসিসিতে সরবরাহকৃত তার ব্যক্তিগত নম্বরে দু’দিন একাধিকবার ফোন করেও বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এ ব্যাপারে শহীদনগর অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ডের ব্যবস্থাপক ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. হাসমত আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘কাউন্সিলর সাহেবের নির্দেশে এই ট্রাকস্ট্যান্ডের কার্যক্রম চলছে। এখানকার চাঁদা উঠিয়ে তার লোকজনের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। একই সঙ্গে লালবাগ থানা ও কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশকে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হয়।’
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, লালবাগ কেল্লারমোড় সংলগ্ন খাস জমি দখল এবং জমির নকল কাগজপত্র তৈরি করে অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন খোকন গড়ে তুলেছে এই ট্রাক টার্মিনাল। বেড়িবাঁধ সড়কের আংশিক চলে গেছে এই ট্রাক টার্মিনালের দখলে। প্রতিদিন এই টার্মিনালে তিন শতাধিক গাড়ি রাখা হয়। ট্রাকপ্রতি এক থেকে দেড়শ’ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বিএনপি সমর্থিত সাবেক এই কাউন্সিলর কয়েক বছর ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। তার ব্যক্তিগত নম্বরে যোগাযোগ করে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তার ট্রাকস্ট্যান্ড পরিচালনার দায়িত্বরতরা এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে তাদের পরিচয় প্রকাশ ও মতামত জানাতে রাজি হননি।
সায়েদাবাদ জনপথের মোড়ে ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা, রেলওয়ে এবং সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে চার শতাধিক ট্রাকের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্ট্যান্ড রয়েছে। এছাড়া পোস্তগোলা ব্রিজ সংলগ্ন সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে সেখানে প্রতিদিন দুই শতাধিক ট্রাক পার্কিং করা হয়। বর্তমান পাগলা বাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে এই ট্রাকস্ট্যান্ড। আওয়ামী ওলামা লীগের দুই নেতা এই ট্রাকস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড় থেকে আমিনবাজার ব্রিজ পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে অন্তত তিন হাজার বাস-ট্রাক পার্কিং করে রাখা হয়। ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধের মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে গাবতলী পশুর হাট পর্যন্ত সড়কে কমপক্ষে আড়াই হাজার বাস-ট্রাক-টেম্পো পার্কিং করে রাখা হয়। যানজটমুক্ত সড়ক বলে পরিচিত এই সড়কে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে রাখায় সড়কটিতেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। স্কুলগামী ছেলেমেয়ে এবং দিনমজুরদের প্রতিদিনই গাড়ি ছেড়ে হেঁটে চলাচল করতে দেখা যায়। বকশিবাজার সিগন্যাল থেকে চানখাঁরপুল সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের জায়গা এবং ফুটপাত দখল করে রাখা হয়েছে বাস-ট্রাক-সিএনজি অটোরিকশা। এই অংশের খোলা জায়গা দখল করে শতাধিক মোটরপার্টসের দোকান ও গ্যারেজ গড়ে তোলা হয়েছে। চানখাঁরপুল সিগন্যাল থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক দখল করে রাখা হয় বাস-ট্রাক-টেম্পোর পাশাপাশি ঘোড়ার গাড়িও। এই সড়কের চিত্র এতই করুণ যে, গাড়ি চলাচল তো দূরের কথা, হেঁটে চলাচল করতেও কষ্ট হয় পথচারীদের।
আরও দেখা গেছে, কমলাপুর টিটিপাড়া থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভার (সবুজবাগের দিকের ঢাল) পর্যন্ত সড়কের একাংশ দখল করে শত শত বাস-টেম্পো-ট্রাক, ট্রেইলার রাখেন পরিবহন মালিকরা। এতে এ সড়কে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। এছাড়া পুরান ঢাকার মালিটোলা ইংলিশ রোডের বিভিন্ন পয়েন্টে ছোট ছোট পিকআপ রাখা হয়েছে। আর বংশাল থানার বিপরীতেও রাস্তা দখল করে রাখা হচ্ছে অসংখ্য ট্রাক।
পুরান ঢাকার বাদামতলী-বাবুবাজার-নয়াবাজার-ইংলিশ রোড পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে ছোট-বড় ট্রাকের স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে ৫ শতাধিক ট্রাক রাখা হয়। এসব মালবাহী ট্রাকের কারণে পুরান ঢাকার এ এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রাবাড়ী কাঁচাবাজারের আড়ৎ সংলগ্ন সড়ক, খালি জায়গায় রাখা হয় শত শত ট্রাক। এসব ট্রাকের কারণে ওই এলাকার সড়কে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলাও করা যায় না। একই চিত্র মহাখালী বাস টার্মিনাল সংলগ্ন এলাকা। টার্মিনালের সামনের দুই সড়ক মহাখালী মোড় পর্যন্ত দিনের অধিকাংশ সময় এবং সারারাত বাস-ট্রাকের দখলে থাকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের গাবতলী শাখার সভাপতি মো. সাদেক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সরকারিভাবে রাজধানী বা আশপাশে রাজধানীর ট্রাক রাখার জন্য কোনো টার্মিনাল তৈরি করা হয়নি। যার কারণেই এক রকম বাধ্য হয়েই ট্রাক মালিকরা সড়ক অথবা সরকারি জমি দখল করে ট্রাক পার্কিং করছে।
তিনি বলেন, গাবতলী বাস টার্মিনালের পেছনে এবং গাবতলী গবাদিপশুর হাট সংলগ্ন সরকারের প্রায় একশ’ একর জমি রয়েছে। এগুলো প্রভাবশালী মহলের দখলে রয়েছে। সরকার এসব জমি দখলমুক্ত করে ট্রাক টার্মিনাল গড়ে তুললে যত্রতত্র ট্রাক পার্কিং বন্ধ হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষমতা বদলের সঙ্গে অবৈধ বাস-ট্রাক টার্মিনালের নিয়ন্ত্রকও বদলে যায়। বর্তমানে রাজধানীর অবৈধ বাস-ট্রাকস্ট্যান্ড এবং গ্যারেজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। আর এসব অবৈধ কার্যক্রমের প্রত্যক্ষ সহযোগী পুলিশ। অবৈধ এসব বাস-ট্রাকস্ট্যান্ড এবং গ্যারেজ টিকিয়ে রাখতে খেটে খাওয়া নিরীহ শ্রমিকদের ব্যবহার করেন মালিক ও প্রভাবশালী মহল। তাদের সরকারি উচ্ছেদ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়।
২৯ নভেম্বর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক তেজগাঁও অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ডের অপসারণ করতে গেলে প্রভাবশালীদের লেলিয়ে দেয় ট্রাক শ্রমিকদের রোষানলে পড়েন। প্রায় চার ঘণ্টা তিনি শ্রমিক ইউনিয়নের অফিসে অবরুদ্ধ ছিলেন। পরে পুলিশ পাহারায় তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর ওই ট্রাকস্ট্যান্ডের অবৈধ স্থাপনা সরাতে আর কোনো অভিযান চালানো হয়নি।
জানতে চাইলে, ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর ভেতর থেকে অবৈধ টার্মিনাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি। এ লক্ষ্যে রাজধানীর আশপাশে জায়গা খোঁজ করছি। তবে তিনি বলেন, সড়ক দখল করে কোনো বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড এবং গ্যারেজ গড়ে সবই উচ্ছেদ করা হবে।
তিনি বলেন, সড়ক-ফুটপাত নগরবাসীর চলাচলের জন্য; এসব জায়গা কোনো বিশেষ মহলের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার হতে দেয়া হবে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, ফুটপাত ও সিটি কর্পোরেশনের জমিতে যেসব অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে সব অপসারণ করা হবে। পুলিশের ট্রাক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার (ঢাকা দক্ষিণ) বনজ কুমার মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সড়কের ওপর পার্কিং করে থাকা ট্রাক উচ্ছেদের বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কথা বলব। তারা চাইলে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর সড়ক-ফুটপাত চলাচলের জন্য। এসব জায়গা দখল করে গাড়ি পার্কিং বা অন্য কোনো স্থাপনা গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, রাজধানীতে প্রভাবশালীরা বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করেই সেসব করেছে। এ কারণে রাজধানীর যানজট অনেকাংশে বেড়েছে। রাজউকের সমালোচনা করে এ পরিকল্পনাবিদ বলেন, রাজধানীর উন্নয়ন পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে না করায় যত্রতত্র অবৈধভাবে ট্রাক-বাসস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে।