ভোজ্যতেলের উত্থান পতন

দামের উত্থান-পতনের মতোই সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার দখলেও চলছে উত্থান-পতন। দ্রুত দাম ওঠা-নামা বা শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার দখলের প্রতিযোগিতা যেকোনো বিবেচনায় অন্য সব ভোগ্যপণ্যের মধ্যে এ দুটি আছে শীর্ষে।
দেশে সয়াবিন ও পাম তেল—এ দুই ভোজ্যতেলের বাজারের ৩২ শতাংশই এখন টিকে গ্রুপের হাতে। গত এক দশকে বাজার দখলের ক্রমতালিকায় উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দ্বিতীয় অবস্থান থেকে পরের দুই বছরে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে পেরেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরপর টানা চার বছর ক্রমতালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ওঠা-নামা হয়েছে তাদের। এরপর তিন বছর ধরে বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ তো গেল উত্থানের গল্প। পতনের গল্পও আছে। ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার দখলে শীর্ষস্থান ছিল নূরজাহান গ্রুপের। পরের বছরই শীর্ষস্থান হারায়। ক্রমতালিকায় নেমে আসে ৫ নম্বরে। এরপর সেরা পাঁচের বাইরে চলে যায় প্রতিষ্ঠানটির নাম। সর্বশেষ হিসাবে নূরজাহান গ্রুপের হাতে আছে বাজারের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। ক্রমতালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে। গত এক দশকে বাজার দখলের ক্রমতালিকায় সবচেয়ে বেশি উত্থান-পতন হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির।
নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, বিশেষ করে পাম তেলের মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে মূল্য পতনের হার ছিল দ্রুত। মূল্য পতন হলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কিনে আনার পর স্থানীয় বাজারে বিক্রির চাপ কমে যায়। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের চাপে কম দামে বিক্রি করতে হয়। শীর্ষ তালিকায় থাকার কারণে আমাদের লোকসানের পরিমাণও ছিল বেশি। তবে এখন পরিমাণে আমদানি কম করলেও নিয়মিত আমদানি অব্যাহত আছে।’
সয়াবিন ও পাম তেলের বাজার অংশীদারির তুলনা করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে। আমদানির কার্যত পুরোটাই আসে এই বন্দর দিয়ে। এর বাইরে মংলা দিয়ে দুই বছর ধরে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করছে। সব মিলিয়ে সয়াবিন ও পাম তেলের বাজারে আছে ১১টি প্রতিষ্ঠান।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ওই ১১ প্রতিষ্ঠান শোধিত ও অশোধিত আকারে আমদানি করেছে সাড়ে ১৭ লাখ টন সয়াবিন ও পাম তেল। সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার এই তেল আমদানিতে সরকার রাজস্ব পায় ১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। বাজারে ভোজ্যতেলের ৯০ শতাংশই পাম ও সয়াবিন।
এর বাইরে ২০টি প্রতিষ্ঠান পরিশোধিত পাম ও সয়াবিন আমদানি করেছে প্রায় ২০ হাজার টন। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং খাদ্য ও পানীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রমতালিকা বিশ্লেষণে এই ২০ প্রতিষ্ঠানের হিসাব ধরা হয়নি।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫ লাখ ৬৩ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করে শীর্ষস্থানে টিকে গ্রুপ। প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করে মেঘনা গ্রুপ দ্বিতীয় এবং ৩ লাখ ৪১ হাজার টন আমদানি করে তৃতীয় অবস্থানে আছে সিটি গ্রুপ। পরের দুই অবস্থানে যথাক্রমে এস. আলম ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড।
জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে সবচেয়ে অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার। এ কারণে ঝুঁকি নিতে হয় বেশি। ভুল করলে টিকে থাকা কষ্টকর। গত অর্থবছরে আমদানি করেছি বেশি, তবে এবার কম করছি।’
উত্থান-পতনের তালিকায় আছে চট্টগ্রামের এস. আলম গ্রুপের নামও। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই শিল্প গ্রুপের হাতে ছিল বাজারের ২৫ শতাংশ। সেবার এস. আলম গ্রুপ ছিল সবার শীর্ষে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দশম অবস্থান থেকে উঠে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। তবে তা একবারই। পরের বছর নেমে আসে তৃতীয় অবস্থানে। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ছিল চতুর্থ অবস্থানে।
শিল্প গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে অর্থে আমদানি কমেনি এস. আলম গ্রুপের। নতুন অর্থবছরে সয়াবিনের আমদানি বাড়িয়েছি। এ মাসে আসছে ৬০ হাজার টন সয়াবিন। এই ধারাবাহিকতা থাকবে।’
ভোজ্যতেলের কথা বললে এক দশক আগে এক নামে পরিচিতি ছিল এমইবি গ্রুপের দাদা ব্র্যান্ড। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানটির হাতে ছিল বাজারের ১৮ শতাংশ। সেবার বাজারে তারা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। এখন এই প্রতিষ্ঠানটির দখলে বাজারের দশমিক ৭৯ শতাংশ।
১০ বছর আগে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষ অবস্থানে ছিল সিটি গ্রুপ। এরপর আর শীর্ষস্থানে ফেরা হয়নি তাদের। একই সময়ে মেঘনা গ্রুপ ছিল তালিকায় দশম অবস্থানে। তবে সময় যত গড়িয়েছে, এ দুই গ্রুপ কাছাকাছি অবস্থানে চলে এসেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে মেঘনার হাতে ছিল বাজারের প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে থাকা মেঘনার
পরই বাজারের পৌনে ৭ শতাংশ অংশীদারি নিয়ে সিটি গ্রুপ ছিল পঞ্চম অবস্থানে। আর গত অর্থবছরে মেঘনা ছিল দ্বিতীয় এবং সিটি তৃতীয় অবস্থানে।
ভোজ্যতেলের বাজারে উত্থান-পতন যতই ঘটুক, শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠানের অংশীদারি কিন্তু প্রতিবছর বাড়ছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠানের হাতে ছিল বাজারের ৫৬ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশে। এরপর চার অর্থবছরে তা যথাক্রমে ৬১, ৬৭, ৭১ ও ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়। অর্থাৎ উত্থান-পতনে প্রতিযোগিতা কমছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

News Banglabd Design by
Website Mela