দার্জিলিং যাত্রার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা

অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার চিন্তাটা মাথায় ঘুর ঘুর করছিল। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় তাই ঠিক করতে পারছিলাম না। এক দিন অফিসের এক কলিগ বললো ভাই চলেন দার্জিলিং যাই। হিমালয় কন্যা দার্জিলিং এর নামটা শুনেই এক পায়ে খাড়া হয়ে গেলাম।  কোন কিছু ভাবনা চিন্তা আর করলাম না। যেই ভাবা সেই কাজ। কয়েক দিনের মধ্যে ভারতের ভিসা করে সেই কলিগসহ রওনা হয়ে গেলাম দার্জিলিং এর উদ্দেশে।

সেই ভ্রমণের সম্পূর্ণ অংশ যদি এখন লিখতে বসি তাইলে আপনাদেরই ভাল লাগবে না। কারণ লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই লেখাটা আপনাদের একঘেয়েমি ধরে যাবে সেটা চাচ্ছি না। তাই আজকে লিখবো দার্জিলিং এর রাস্তা নিয়ে।

দার্জিলিং শহরটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফুট উপরে। যেখানে আমাদের বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়াটার উচ্চতা সারে তিন হাজার ফুটের মত। পাহাড়ের উপরের শহর। রাস্তাগুলো ও পাহারের ঢাল কেটে বানানো। একে তো ছয় হাজার ফুট উচ্চতা তার উপর পাহারের ঢাল ঘেঁষে রাস্তা ভাবলেই কেমন একটা ভয় ভয় কাজ করছিল যাওয়ার আগেই। যদিও যাওয়ার আগে দার্জিলিং নিয়ে অনেক পড়া শোনা করেছি। যতোই পড়া শোনা করা হোক না কেন, বিপদের সামনে পরলে কি আর পড়া শোনা মনে থাকে। যাই হোক আসল কথায় আসি।

রাতে ঢাকা থেকে শ্যামলী বাসে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সকাল সকাল বুড়িমারি বর্ডার ক্রস করে দুপুরের মধ্যেই শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম। যদিও আরো ঘণ্টা ৩ আগেই পৌঁছানোর কথা ছিল। থাক সেটা আর বলতে চাচ্ছি না।

শিলিগুড়িতে নেমে আমি আর আমার কলিগ, আর বাকি বাস যাত্রীরা হাঁটছিলাম জিপ স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। একমাত্র এই জিপ গাড়িতেই দার্জিলিং এ যাওয়া যায়। যাওয়ার তাড়াটা অনেক বেশি ছিল কারণ, সন্ধ্যার পর ঐ পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চলবে না, তার উপর পথ প্রায় তিন চার ঘণ্টার। ভাগ্যটা ভাল ছিল, স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার আগেই একটি গাড়ি পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমাদের ২ জনের জন্য ভাড়া অনেক বেশি। তাই অন্য বাংলাদেশি যারা ছিলেন তাদের কয়েকজনকে সাথে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম দার্জিলিং এর উদ্দেশে। শিলিগুড়ির চা বাগানের ভিতর দিয়ে যখন গাড়ি যাচ্ছিল, সবার নজর ছিল জানালার বাইরে। কারণ চারপাশটাই অসম্ভব সুন্দর, যেনো কোন ফটোগ্রাফারের ল্যান্ডস্কাপ। পাহাড়ের কাছাকাছি পোঁছাতে লাগলো ঘণ্টা খানেক এর মত। পাহাড়ের নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের উঁচু অংশ মেঘে ঢেকে আছে। হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছিল মেঘের ভিতর থেকে গাড়ি বের হয়ে আসছে। নিচ থেকে সেই গাড়ি গুলোকে দেখাচ্ছিল পিঁপড়ের মত। আমাদের ড্রাইভার আবার আমাদের দেখিয়ে বললো ঐ রাস্তা দিয়েই আমরা যাব। শুনে গাড়িতে থাকা মোটা মুটি সবার চেহারা ফেঁকাসে হয়ে গেল ভয়ে। যদিও আমার উচ্চতা ভয় তেমন নেই, তারপরও অন্যদের অবস্থা দেখে নিজেও কনফিডেন্সের অভাব বোধ করলাম। যাই হোক যেতে যেহেতু হবেই আমরাও যাওয়া শুরু করলাম। পাহারের উপর রাস্তা গুলো দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোন একটা বিশাল সাপ যেন এঁকে বেঁকে পাহারের ঢাল বেয়ে উঠছে। আমরাও উঠছি। রাস্তা গুলো অনেক সরু। কোন রকমে দুটি জিপ যেতে পারবে। একটু বড় গাড়ি হলেই আর চলবে না। সবই ঠিক ছিল। সবাই যখনই রাস্তার সাথে অভ্যস্ত হতে শুরু করলো তখনি নতুন বিপদ। রাস্তা গিয়ে ঢুকলো মেঘের ভিতরে। পাঁচ ফুট সামনের কিছুও দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্যে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে অনেক গতিতে। যতই সবাই অনুরোধ করছে আস্তে চালানোর জন্য তার সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। কারণ কোন কারণে একবার একটু এদিক সেদিক হলেই গাড়ি গিয়ে পরবে হাজার ফুট নিচে। যেখান থেকে লাশ খুঁজে পেতেও তিন চার দিন লেগে যাবে। বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম রাস্তার ঢালের পাশের নিরাপত্তা বেষ্টনী গুলো ভাঙ্গা। কারণটা অনুমান করতে পারলেও ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম। ড্রাইভার বললো এই দিক দিয়ে গাড়ি নিচে পড়ে গেছে। তাই ভাঙ্গা। বোঝেন অবস্থা, এমনিতেই সবাই ভয়ে আছে, এই কথা শুনার পর কয়েক জন জোরে জোরে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা শুরু করলো। একজন তো বলে উঠলো আমাকে নামিয়ে দিন, আমি হেঁটে যাবো। তাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করা হলো। ততক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। আমরা ভয় পেলেও সুন্দর ভাবেই যাচ্ছিলাম।  বিধাতাও মনে হয় চাননি আমরা সহজে দার্জিলিং এ পৌঁছাই। তিনি হয়তো ভেবেছেন, এতো ভয় নিয়ে যেহেতু এসেই পরেছ তাইলে একটু আসল ভয়ই পাও, দেখ কেমন লাগে। হলো ও তাই। এই মেঘাচ্ছন্ন সরু রাস্তার এক জায়গায় গাড়ি প্রায় ৩৬০ডিগ্রী একটা বাঁক নিয়ে উপরে উঠছিল রাস্তাটা। মেঘের কারণে কেও দেখতে পাইনি সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা পিকআপ ভ্যান। একে বারে বাঁকের মুখে। আমাদের গাড়ি ব্রেক করলো পিকআপের ঠিক এক ফুট সামনে এসে। ভাবছেন যাক বেঁচে গেছি। আসল বিপদ তো শুরু হলো এর পর। আমাদের গাড়ি যেহেতু উপরের দিকে উঠছিল, ব্রেক করার কারণে গাড়ি থেমে গেল ঠিকই কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই গাড়ি পিছনের দিকে পিছলাতে শুরু করলো। অনেকেই ভয়ে কান্না কাটি শুরু করলো। আমরা যারা গাড়ির দরজার পাসে ছিলাম, তারা কোন মতে দরজা খুলে গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম। গাড়ি পিছলে যাচ্ছে নিচের দিকে আর চাকা থেকে পোড়া গন্ধ বের হচ্ছিল তখন, সব হচ্ছিল চোখের সামনে, সবাইকে নামার জন্য ডাকছি, কিন্তু তাদের কি করা উচিত সেটা বুঝতে পারছিল না। গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা খেল ছয় সাত ফুট পিছনের ঢালের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে। গতি কম থাকায় গাড়িটা সেখানেই আটকে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি ভাগ্যিস নিরাপত্তা বেষ্টনীটা ছিল, অন্য অংশের মত যদি এটাও ভাঙ্গা থাকতো তাইলে কি অবস্থা হতো। সবাই একটু ধাতস্থ হওয়ার পর, সবাই মিলে এগিয়ে গেলাম পিকআপ ড্রাইভারের উপর সম্পূর্ণ রাগ ঝাড়ার জন্য। কারণ তার গাফিলতিতেই আমরা সবাই প্রায় মরতে বসেছিলাম। কিন্তু আমরা যা চাইবো তা যে হবেনা সেটা আবার প্রমাণ হলো। পিকআপের ড্রাইভিং সিট ছিল ফাঁকা। এর গর্ধব ড্রাইভার পিকআপটাকে এমন ভয়ংকর বাঁকে পার্ক করে চলে গেছে। ড্রাইভারকে তো আর পেলাম না, তাই বাধ্য হয়ে তার গাড়িকে কথা শুনালাম। হয়তো তখন ভেবেছিলাম, এই গাড়িই আমাদের কথা গুলো তর্জমা করে মালিককে শুনাবে। আসলে মাথাই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। যাই হোক আবার রওয়ানা দিলাম ভয় ভয় মন নিয়ে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন মেঘ সরে যাচ্ছিল আর আসে পাশের অপূর্ব দৃশ্য গুলো চোখের সামনে ফুটে উঠছিল, তখন সবার ভয় কোথায় যে হারিয়ে গেল আর খুঁজে পাওয়া গেল না। দার্জিলিং পৌঁছানোর বাকি রাস্তাটা আমরা সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি দেখতে দেখতে পার করে দিলাম। মাঝে মাঝে আবার কোথাও গাড়ি থামিয়ে ছবিও তুললাম। আর কোন বিপাদ ছাড়াই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে একটা সময় পর পৌঁছেও গেলাম স্বপ্নের দার্জিলিং শহরে।

(চলবে)

লেখকঃ মসিউল ইসলাম খান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

News Banglabd Design by
Website Mela